১৯৪৭ সনে দ্বি-জাতি তত্ত্বের ভিত্তিতে ভারতবর্ষ বিভক্ত হয়েছিল অবৈজ্ঞানিক দ্বি-জাতি তত্ত্ব পরবর্তীতে অসার প্রমাণিত হয়। ফলশ্রুতিতে উন্মেষ ঘটে বাঙ্গালী জাতীয়তাবাদের। ১৯৭১ সনে সশস্ত্র সংগ্রামের মাধ্যমে বাংলাদেশের জন্ম হয়। পৃথিবীর মানচিত্রে প্রতিষ্ঠিত হয় স্বাধীন সার্বভৌম বাংলাদেশ।
সশস্ত্র সংগ্রামের মাধ্যমে বিপুল রক্তের বিনিময়ে স্বাধীনতা অর্জন পৃথিবীর ইতিহাসে এক বিরল ঘটনা। রক্তমূল্যে অর্জিত স্বাধীনতায় সুনামগঞ্জ জেলার অবদান উল্লেখযোগ্য।
স্বাধীনতাযুদ্ধে সুনামগঞ্জ জেলা ছিল জাতীয়ভাবে বিভক্ত সেক্টর-৫ এর অন্তর্গত। ৫নং সেক্টরের বিস্তৃতি মূলত সুনামগঞ্জ জেলা বা সাবেক সুনামগঞ্জ মহকুমাব্যাপী। সেক্টর কমান্ডার ছিলেন কর্নেল মীর শওকত আলী।
সুনামগঞ্জ জেলা স্বাধীন বাংলা সংগ্রাম পরিষদ মুক্তিযুদ্ধের সূচনা থেকে শেষ পর্যন্ত গৌরবজ্জ্বল ভূমিকা পালন করেছে। একই ভাবে অবদান রেখেছে এ জেলার সংগ্রামী ছাত্র জনতা ও সর্বস্তরের জনগণ। অনন্য উদাহরণ সৃষ্টি করেছে এ জেলার হাজার হাজার মুক্তিযোদ্ধা। বার বার মোকাবিলা করেছে পাক হানাদার বাহিনীকে। মুক্ত রেখেছে জেলার অধিকাংশ স্থান। এ জেলায় মুক্তিযুদ্ধে অংশ গ্রহণ করেছে পুলিশ বাহিনীর কিছু সদস্য ও ই.পি.আর সদস্য। সর্বোপরি বেঙ্গল রেজিমেন্টের কয়েকটি কোম্পানির সমন্বয়ে জেড-ফোর্স যুদ্ধ করেছে বীর দর্পে। অনেক রাজনৈতিক নেতা-কর্মী পালন করেছেন সংগঠনের গুরুদায়িত্ব।
তারই সংক্ষিপ্ত বর্ণনা তুলে ধরা হলো।
বালাট সাব-সেক্টরঃ প্রথম সাব-সেক্টর কমান্ডার ক্যাপ্টেন সালাহউদ্দিন (পরে লেঃ কঃ হয়ে অবসর নেন)। তৎপরবর্তী সাব-সেক্টর কম্যান্ডার আগরতলা মামলা খ্যাত মেজর (অবঃ) এম. এ. মুত্তালিব। তাছাড়া এখানে ছিলেন এস কে লালা বর্তমানে প্রকৌশলী হিসেবে কর্মরত। এখানে মুক্তিযুদ্ধ পরিচালনায় ঘনিষ্ঠ সহযোগিতা করেছেন যারা তাঁরা হলেন দেওয়ান ওবায়দুর রেজা চৌধুরী, আলফাত উদ্দিন আহমদ, আব্দুল হাই, ডাঃ মকব্বির আলী, আব্দুল বারী, সৈয়দ দেলোয়ার হোসেন, আব্দুর রইছ, আছদ্দর আলী চৌধুরী প্রমুখ।
সেলা সাব-সেক্টরঃ সাব-সেক্টর কমান্ডার ক্যাপ্টেন এ, এস হেলাল উদ্দিন। এখানে ছিলেন লেঃ রউফ, পরে লেঃ কঃ হয়ে অবসর নেন, বর্তমানে ব্যবসায়ী। এখানে লেঃ মাহবুবও ছিলেন। তাঁদের যুদ্ধ পরিচালনায় ঘনিষ্টভাবে সহযোগিতা করেছেন আঃ হক, এম.এন.এ. শহীদ চৌধুরী ও ইদ্রিছ আলী বীর-প্রতীক।
ভোলাগঞ্জ সাব-সেক্টরঃ প্রথমদিকে সাব সেক্টর সংগঠিত করেন কয়েস চৌধুরী। বর্তমানে বিদেশ অবস্থান করেছেন। পরে তদস্থলে কাজ করেন মদরিছ আলী বি. এ. বর্তমানে কোম্পানীগঞ্জের উপজেলা চেয়ারম্যান। সাব-সেক্টর কমান্ডার নিযুক্ত হয়ে আসেন লেঃ তাহির উদ্দিন আখঞ্জী (পরে মেজর হয়ে অবসর নেন)। বর্তমানে বি.আর.টি.সি- তে দায়িত্বশীল পদে কর্মরত আছেন। এখানে লেঃ এস.এম. খালেদও ছিলেন। তিনি জিয়া হত্যাকাণ্ডের পর থেকে নিরুদ্দেশ। এদের যুদ্ধ পরিচালনায় ঘনিষ্টভাবে সহযোগিতা করেন ডাঃ হারিছ আলী, বর্তমানে ব্যক্তিগত চিকিৎসা ব্যবসায় নিয়োজিত।
টেকেরঘাট সাব-সেক্টরঃ সাব-সেক্টর কমান্ডার প্রথম দিকে বাবু সুরঞ্জিত সেন গুপ্ত এম.পি.এ. এবং পরে মেজর মোসলেমউদ্দিন (প্রকাশিত মেজর দীন)। যুদ্ধ পরিচালনায় ঘনিষ্ট সহযোগীদের মধ্যে রয়েছেন হোসেন বখত, আব্দুজ জহুর, আলী ইউনুছ, সালেহ চৌধুরী, নজির হোসেন, ডাঃ নজরুল হক, মাহফুজ ভূঞা প্রমুখ।
মহেষখলা সাব-সেক্টরঃ মহেষখলা ভৌগোলিকভাবে সুনামগঞ্জ জেলার ধর্মপাশা উপজেলায়। কিন্তু মুক্তিযুদ্ধের সময় এটা ছিল নেত্রকোনা জেলার সাথে সংযুক্ত। জনাব আঃ হেকিম চৌধুরী মহেষখলায় মুক্তিযুদ্ধ সংগঠিত করেন।
এছাড়া জেডফোর্সের ৩য় ইস্ট বেঙ্গল রেজিমেন্ট অক্টোবর মাসে ছাতক পাক বাহিনীকে আক্রমণ করে। এদের নেতৃত্বে ছিলেন মেজর শাফায়েত জামিল, পরে কর্নেল হয়ে অবসর নেন। এই ৩য় বেঙ্গলের ৪টি কোম্পানী কম্যান্ড করতেন কঃ আনোয়ার হোসেন, বর্তমানে ব্রিগেডিয়ার ও চীনে সামরিক এটাচে হিসেবে কর্মরত।
ক্যাপ্টেন আকবর হোসেনও ছাতক যুদ্ধে বলিষ্ঠ ভূমিকা রাখেন। পরে কর্নেল হয়ে অবসর নেন এবং প্রেসিডেন্ট জিয়ার অধীনে মন্ত্রী হন। ক্যাপ্টেন মহসীন উদ্দিন আহমদ (পরে ব্রিগেডিয়ার) জিয়া হত্যায় মৃত্যুদন্ড প্রাপ্ত। লেঃ নূরন্নবী খান পরে মেজর হয়ে অবসর নেন, বর্তমানে ব্যবসায়ী। তাছাড়া ছাতক যুদ্ধে অংশ নেন লেঃ মঞ্জুর, পরে মেজর হয়ে অবসর নেন। বর্তমানে বিদেশে আছেন। লেঃ ফজলে হোসেন পরে লেঃ কঃ হন এবং জিয়া হত্যা মামলায় মৃত্যুদন্ড প্রাপ্ত।
উৎসঃ মোহাম্মদ আলী ইউনুছ কর্তৃক সম্পাদিত ১৯৯০ সালে প্রকাশিত ‘মুক্তিযুদ্ধে সুনামগঞ্জ’ গ্রন্থ।
পরিকল্পনা ও বাস্তবায়নে: মন্ত্রিপরিষদ বিভাগ, এটুআই, বিসিসি, ডিওআইসিটি ও বেসিস