ইতিহাসের গতিধারায় সুনামগঞ্জ
সন | ইতিহাস |
১৪৭৪ খ্রিস্টাব্দ | মুবারক দৌলা মালিক লাউরের উজির হন |
১৭৮৭ খ্রিস্টাব্দ | খাসিয়া কর্তৃক সেলবরষ, রামধীঘা ও বংশীকুন্ডা পরগনা আক্রমণ ও ৩০০ লোক হত্যা |
১৭৯৪ খ্রিস্টাব্দ | ছাতকে ইংলিশ কোম্পানি স্থাপন |
১৭৮৯ খ্রিস্টাব্দ | দশসনা বন্দোবস্ত |
১৭৮৮-৯০ খ্রিস্টাব্দ | হস্তবোধ জরিপ |
১৭৯৩ খ্রিস্টাব্দ | চিরস্থায়ী বন্দোবস্ত |
১৮৩৩ খ্রিস্টাব্দ | মরমী কবি রাধারমণ দত্ত পুরকায়স্থের জন্ম |
১৮৫৪ খ্রিস্টাব্দ | মরমী কবি হাছন রাজার জন্ম |
১৮৬০-৬৬ খ্রিস্টাব্দ | থাকবাস্ত জরিপ |
১৮৭৪ খ্রিস্টাব্দ | বৃহত্তর সিলেট জেলাকে আসামের অন্তর্ভূক্তকরণ |
১৮৭৭ খ্রিস্টাব্দ | সুনামগঞ্জ মহকুমা স্থাপন |
১৮৮০ খ্রিস্টাব্দ | সুনামগঞ্জ সদর থানা স্থাপন |
১৮৮৭ খ্রিস্টাব্দ | সরকারী জুবিলী উচ্চ বিদ্যালয় প্রতিষ্ঠা |
১৮৯৭ খ্রিস্টাব্দ | ভয়াবহ ভূমিকম্প |
১৯০২ খ্রিস্টাব্দ | গৌরীপুর জমিদার কর্তৃক ছাতকের ইংলিশ কোম্পানি ক্রয় |
১৯০৫ খ্রিস্টাব্দ | বঙ্গভঙ্গ |
১৯১১ খ্রিস্টাব্দ | বঙ্গভঙ্গ রোধ |
১৯১৬ খ্রিস্টাব্দ | মরমী কবি রাধারমণ দত্তের মৃত্যু |
১৯১৯ খ্রিস্টাব্দ | শাল্লা থানা স্থাপন ও সুনামগঞ্জ পৌরসভার প্রতিষ্ঠা |
১৯২২ খ্রিস্টাব্দ | মরমী কবি হাছন রাজার মৃত্যু, ছাতক ও জগন্নাথপুর থানা স্থাপন |
১৯৩৬ খ্রিস্টাব্দ | সিলেট প্রজাস্বত্ব আইন প্রণয়ন |
১৯৪০ খ্রিস্টাব্দ | জামালগঞ্জ থানা স্থাপন ও ছাতক সিমেন্ট কারখানা প্রতিষ্ঠা |
১৯৪২ খ্রিস্টাব্দ | দিরাই, তাহিরপুর ও ধর্মপাশা থানা স্থাপন |
১৯৪৪ খ্রিস্টাব্দ | সুনামগঞ্জ কলেজ প্রতিষ্ঠা |
১৯৪৬ খ্রিস্টাব্দ | সাধারণ নির্বাচন |
১৯৪৭ খ্রিস্টাব্দ | গণভোট ও দেশ বিভাগ |
১৯৫০ খ্রিস্টাব্দ | পূর্ববাংলা প্রজাস্বত্ব আইন ও জমিদারী প্রথা বিলোপ |
১৯৫৪ খ্রিস্টাব্দ | যুক্তফ্রন্টের বিজয় ও ছাতকে রেল লাইন প্রতিষ্ঠা |
১৯৫৬ খ্রিস্টাব্দ | মহকুমা আইনজীবী সমিতি প্রতিষ্ঠা |
১৯৫৯ খ্রিস্টাব্দ | সুনামগঞ্জ পাবলিক লাইব্রেরী প্রতিষ্ঠা |
১৯৬১ খ্রিস্টাব্দ | শিল্পকলা একাডেমী প্রতিষ্ঠা |
১৯৭১ খ্রিস্টাব্দ | স্বাধীনতা লাভ |
১৯৭৬ খ্রিস্টাব্দ | বিশ্বম্ভরপুর, দোয়ারাবাজার ও তাহিরপুর থানা স্থাপন |
১৯৭৭ খ্রিস্টাব্দ | সুনামগঞ্জ অফিসার্স ক্লাব প্রতিষ্ঠা |
১৯৮৪ খ্রিস্টাব্দ | সুনামগঞ্জ মহকুমা জেলায় উন্নীত |
১৯৯৫ খ্রিস্টাব্দ | সিলেট বিভাগ এর কার্যক্রম শুরু |
২০০৭ খ্রিস্টাব্দ | দক্ষিণ সুনামগঞ্জ থানা স্থাপন |
তথ্যের উৎস : ১. জেলা প্রশাসকের কার্যালয়, অক্টোবর ২০০৮, ২. সুনামগঞ্জ জেলার ইতিহাস ও ঐতিহ্য (১৯৫৫) : আবু আলী সাজ্জাদ হোসাইন
নামকরণ: ‘সুনামদি’ নামক জনৈক মোগল সিপাহীর নামানুসারে সুনামগঞ্জের নামকরণ করা হয়েছিল বলে জানা যায়। ‘সুনামদি’ (সুনাম উদ্দিনের আঞ্চলিক রূপ) নামক উক্ত মোগল সৈন্যের কোন এক যুদ্ধে বীরোচিত কৃতিত্বের জন্য সম্রাট কর্তৃক সুনামদিকে এখানে কিছু ভূমি পুরস্কার হিসাবে দান করা হয়। তাঁর দানস্বরূপ প্রাপ্ত ভূমিতে তাঁরই নামে সুনামগঞ্জ বাজারটি স্থাপিত হয়েছিল। এভাবে সুনামগঞ্জ নামের ও স্থানের উৎপত্তি হয়েছিল বলে মনে করা হয়ে থাকে।
প্রাচীন ইতিহাস: সুনামগঞ্জের ইতিহাস অতি প্রাচীন। অসংখ্য কিংবদন্তী এবং ঐতিহাসিক ঘটনাবলী ও তথ্যাবলীতে সমৃদ্ধ। প্রাচীন ইতিহাস থেকে অনুমান করা হয়, সুনামগঞ্জ জেলার সমগ্র অঞ্চল এককালে আসামের কামরূপ বা প্রাগজ্যোতিষপুর রাজ্যের অন্তর্গত ছিল। সুনামগঞ্জের লাউড় পরগনায় এখনো প্রবাদ হিসেবে কথিত আছে লাউড় পাহাড়ের উপরই কামরূপের রাজা ‘ভগদত্তের’ রাজধানী ছিল। এ ভগদত্ত কুরুক্ষেত্রের যুদ্ধে কৌরবদের পক্ষে যুদ্ধ করেছিলেন বলেও কিংবদন্তী রয়েছে। টাংগাইলের মধুপুর বনেও উক্ত রাজবাড়ীর চিহ্ন ছিল বলে জানা যায়। ঐতিহাসিকদের মতে, এ ভগদত্ত ও মহাভারতের ভগদত্ত এক ব্যক্তি নন, বরং কথিত ভগদত্ত মহাভারতের অনেক পরের কালের মানুষ। এটাই সত্য। কারণ কিংবদন্তী ও ইতিহাস যেখানে মিল হবে না সেখানে ইতিহাস ভিত্তি ধরাই বিধেয়।
বৃহত্তর সিলেট সুদূর অতীতে তিনটি ভিন্ন ভিন্ন স্বাধীন রাজ্যে বিভক্ত ছিল। এ রাজ্যগুলো হচ্ছে লাউড়, গৌড় ও জয়ন্তিয়া। অনুমান করা হয়, এ লাউড় রাজ্যের সীমানা বর্তমান সমগ্র সুনামগঞ্জ জেলা ও ময়মনসিংহ জেলা এবং হবিগঞ্জ জেলার কিয়দংশ নিয়ে গঠিত ছিল। এ রাজ্যের রাজধানী ছিল লাউড়। সুনামগঞ্জ জেলার তাহিরপুর থানার উত্তর বড়দল ইউনিয়নের হলহলিয়া নামে পরিচিতি গ্রামে লাউড়ের রাজা বিজয় সিংহের বাসস্থানের ধ্বংসাবশেষের চিহ্ন এখনো বিদ্যমান। স্থানীয়ভাবে এটি হাবেলী (হাওলী) নামে পরিচিতি।
লাউড় রাজ্যের নৌঘাঁটি ছিল দিনারপুর নামক স্থানে। এটি বর্তমান হবিগঞ্জ জেলার অন্তর্গত। রাজধানী লাউড় থেকে নৌঘাঁটি পর্যন্ত সারা বছর চলাচল উপযোগী একটি ট্রাংক রোডের অস্তিত্ব সম্পর্কে ঐতিহাসিকদের সমর্থন পাওয়া যায়। সুনামগঞ্জের তদানীন্তন ডেপুটি ইন্সপেক্টর অব স্কুলস জনাব মুহাম্মদ ওয়াসিল উক্ত ট্রাংক রোডের ধ্বংসাবশেষ থেকে এ তথ্য উদঘাটন করেছিলেন। মনে করা হয় লাউড় অধিপতি কর্তৃক এ ট্রাংক রোডটি নৌঘাঁটিতে সংযোগ স্থাপনের জন্যই নির্মিত হয়েছিল।
অনুমান করা হয়, সুনামগঞ্জ জেলার বেশীর ভাগ অঞ্চল এককালে একটি সাগরের বুকে নিমজ্জিত ছিল যা কালে কালে পলি ভরাট জনিত কারণে ও ভূ-প্রাকৃতিক পরিবর্তনের সূত্র ধরে ভূখণ্ডে পরিণত হয়েছে। সুনামগঞ্জের ভূগর্ভে চুনা পাথরের খনি ও কয়লা আবিষ্কারের ফলে এরূপ চিন্তার সক্রিয় সমর্থন পাওয়া যাচ্ছে। এ ছাড়া এখানকার শত শত হাওরের গঠন প্রকৃতি (basin type) বিশ্লেষণ করেও এ মতের সমর্থন দৃঢ় ভিত্তিতে দাঁড়িয়ে যাচ্ছে। সুনামগঞ্জের টেকেরঘাট প্রাপ্ত চুনাপাথর এক ধরণের ক্যালসিয়াম যা সামুদ্রিক প্রাচীন শামুক ও শৈবাল দ্বারা সৃষ্ট। এতেও পূর্বোক্ত ধারণার পেছনে বৈজ্ঞানিক যোগ সূত্র খুঁজে পাওয়া যায়।
প্রায় সব ঐতিহাসিক সূত্র মতে, সুনামগঞ্জের বিশাল ভূখণ্ড যে সাগর বক্ষ থেকে জেগে উঠেছে সে সাগরকে ‘কালিদহ’ সাগর বলে চিহ্নিত করা হয়েছে। এ কালিদহ সাগর সুনামগঞ্জ জেলার সমগ্র দক্ষিণাঞ্চল জুড়ে বিস্তৃত ছিল। হাছন রাজার জ্যেষ্ঠ পুত্র খান বাহাদুর দেওয়ান গনিউর রাজা চৌধুরীর আত্মজীবনীমূলক রোজনামচাতেও এর উল্লেখ রয়েছে; রয়েছে বিভিন্ন আঞ্চলিক গান, পালা-পার্বণের অনুষ্ঠানগুলিতেও।
সিলেটের কালেক্টর মিঃ লিন্ডসের অষ্টাদশ শতাব্দীতে লিখিত বর্ণনা থেকেও এর সমর্থন পাওয়া যায়। তিনি লিখেছেন- “In the pre Historic days the southern part of Sadar Subdivision and the northern part of Moulivibazar and Habiganj Subdivision and nearly the entire Sunamganj Subdivision were a part of Bay of Bengal.”
হাওর শব্দটি সায়র (সাগর) থেকে এসেছে। বর্ষাকালে সুনামগঞ্জের হাওরগুলো এখনো সে রূপই ধারণ করে। সুদূর অতীতে এই কালিদহ সাগর বঙ্গোপসাগর পর্যন্ত বিস্তৃত ছিল, যার উপর দিয়ে ১০১১ খ্রিষ্টাব্দে চৈনিক পরিব্রাজক হিউয়েন সাং জাহাজে করে সরাসরি তাম্রলিপ্ত থেকে সিলেট পৌঁছেছিলেন বলে তাঁর লেখা থেকে জানা যায়। তাঁর মতে, নহরী আজরক নামে একটি নদী কামরূপের পাহাড় থেকে উৎপন্ন হয়ে হাবাং শহরের মধ্য দিয়ে প্রবাহিত হয়েছে। এ নদী দিয়ে বাংলা ও গৌড়ে যাওয়া যেত। এ নদীকে প্রাচীন সুরমা বলে ঐতিহাসিকরা মনে করে থাকেন।
পরিকল্পনা ও বাস্তবায়নে: মন্ত্রিপরিষদ বিভাগ, এটুআই, বিসিসি, ডিওআইসিটি ও বেসিস